বায়ুচাপ কি?

2
বায়ুচাপ কি?

আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাই আজ আমরা অধ্যায়ন করবো ভূগোলের একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় নিয়ে যে বিষয়টি পরীক্ষার জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে খুবই উপকারী। এই বিষয়টি ছাত্রছাত্রীরা অধ্যায়ন করলে পরীক্ষায় খুব সহজেই ভালো নম্বর অর্যন করতে পারবে তাই তাদের কাছে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বায়ুচাপ কি এই বিষয়টি নিয়ে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

Advertisement

বায়ুচাপ কি?

পৃথিবীর চারদিকে বায়ুমন্ডল বেষ্টন করে আছে । পৃথিবী তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সাহায্যে বায়ুমন্ডলকে নিজের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে । ফলে অন্যান্য পদার্থের মত বায়ুরও ওজন অনুভূত হয় । বায়ুর এই ওজনকেই বায়ুচাপ (Pressure of Air) বলে ।

সমুদ্রপৃষ্ঠে বায়ুর চাপ এক বর্গ ইঞ্চিতে ১৪.৭ পাউন্ড বা প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ১ কিলোগ্রাম ওজনের সমান । আবার, অন্য হিসাবে এক ইঞ্চি পারদের চাপ ৪৩ মিলিবারের সমান ধরা হয় । যতই উপরে ওঠা যায় বায়ুস্তরের গভীরতা ততই কম হয় । সেইজন্য চাপও কমে যায় । বিভিন্ন স্থানের বায়ুর চাপের মধ্যে পার্থক্য থাকে । এমনকি সকল সময়েও এক স্থানে বায়ুর চাপ সমান থাকে না । ব্যারোমিটারে পারদ স্তম্ভের উচ্চতা দ্বারা বায়ুমন্ডলের চাপ মাপা হয় । সমুদ্রপৃষ্ঠে বায়ুর স্বাভাবিক চাপ ২৯.৯২ ইঞ্চি বা ৭৬০ মিলিমিটার পারদ স্তম্ভের সমান । বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই বায়ুর চাপ ইঞ্চির পরিবর্তে মিলিবারে প্রকাশ করা হয় । ১ মিলিবার হল এমন একটি শক্তি যা প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ১০০০ ডাইন (Dynes) চাপ দেয় । পারদ স্তম্ভের একের দশ ইঞ্চি প্রায় ২.৪ মিলিবারের সমান । সমুদ্রপৃষ্ঠের ২৯.৯২ ইঞ্চি বায়ুর চাপ ৭৬০ মিলিমিটার বা ১০১৩.২ মিলিবারের সমান হয়ে থাকে ।

বায়ুচাপ পরিমাপক যন্ত্রঃ

বায়ুচাপ মূলত ব্যারোমিটার যন্ত্রের সাহায্যে মাপা হয় । নিম্নে কয়েক প্রকার ব্যারোমিটার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো

  1. টরিসেলি ব্যারোমিটারঃ ১৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ইতালীয় পদার্থবিদ টরিসেলি প্রথম বায়ুচাপমাপক যন্ত্র আবিস্কার করেন এবং তার নামানুসারেই যন্ত্রটির নাম হয় টরিসেলি ব্যারোমিটার । এইপ্রকার ব্যারোমিটার ১০০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ সমপ্রস্থচ্ছেদবিশিষ্ট মোটা একটি একমুখ বন্ধ কাঁচনলকে বিশুদ্ধ ও শুষ্ক পারদে পূর্ণ করা থাকে । বায়ুর চাপ পারদের মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হয়ে কাঁচনলের ভিতর উর্দ্ধমুখে ক্রিয়া করে পারদস্তম্ভকে উপরের দিকে ঠেলে রাখে, যার সাহায্যে বায়ুমন্ডলীয় চাপ নির্ণয় করা যায় ।
  2. ফর্টিনস ব্যারোমিটারঃ বিজ্ঞানী ফর্টিনের আবিষ্কৃত ব্যারোমিটারটিকে ফর্টিনস ব্যারোমিটার বলে । এই যন্ত্রে বায়ুচাপ নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা হয় । এই ব্যারোমিটারে মূল স্কেলের সাথে ভার্নিয়ার স্কেল যুক্ত থাকে । এই ব্যারোমিটারের মধভাগে একটি পারদপূর্ণ পাত্র থাকে এবং এর সাথে একটি নল যুক্ত থাকে । পারদপাত্রের পারদতলকে সর্বদাই একই তলে রাখা হয় । বায়ুচাপ পরিবর্তনের সাথে সাথে এই নলে পারদের উচ্চতার তারতম্য ঘটে । বায়ুচাপ নির্ণয়ের সাথে সাথে এই যন্ত্র আবহাওয়ার পূর্বাভাস যেমন- বৃষ্টিপাত, ঝড় প্রভৃতির সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে ।
  3. অ্যানির‍য়েড ব্যারোমিটারঃ ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসী বিজ্ঞানী লুসিয়ান ভিদি এইপ্রকার ব্যারোমিটার আবিষ্কার করেন । এতে কোনোপ্রকার তরল থাকে না । এইপ্রকার ব্যারোমিটার একটি ছোট ধাতব বাক্সে ব্যবহার করা হয়, যা অ্যানিরয়েড সেল নামে পরিচিত । এই বাক্সটি মূলত কপার ও বেরিলিয়ামের মিশ্রণ দ্বারা বানানো হয় । যন্ত্রের ভিতরের বায়ু বের করে নিলে বাইরের বায়ুর চাপে যন্ত্রের কাঁটা প্রভাবিত হয় ও চাপ নির্দেশিত হয় । এটি আকারে ছোট এবং সহজে বহন ও ব্যবহার করা যায় । নৌকা, ছোট বিমান, অফিসে এইপ্রকার ব্যারোমিটার অধিক ব্যবহার করা হয় । হালকা ও ছোট হওয়ায় পর্বতারোহীরা এই ব্যারোমিটার ব্যবহার করে থাকেন ।
  4. কিউ ব্যারোমিটার: প্রভৃতিও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ব্যারোমিটার ।উল্লেখ্য, অল্টিমিটার যন্ত্রের সাহায্যেও উচ্চতার সাথে সাথে বায়ুচাপ মাপা হয়; যেমন- ব্যারোমেট্রিক অল্টিমিটার । এটি বিমান, হেলিকপ্টার প্রভৃতিতে ব্যবহার করা হয় ।বর্তমানে বেশ কিছু উন্নত ও আধুনিক স্মার্টফোনেও বায়ুচাপের তথ্য পাওয়া যায় ।

প্রকারভেদঃ

বায়ুচাপ মূলত দুই প্রকার । যথা – উচ্চচাপ (High Pressure) নিম্নচাপ (Low Pressure) । নীচে এই দুইপ্রকার বায়ুচাপ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

উচ্চচাপঃ

ভূ-পৃষ্ঠের কোনো নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট আয়তনের বায়ুর চাপ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অপেক্ষা বেড়ে গিয়ে যখন সেটি ১০১৩ মিলিবার বা তার বেশী হয়, তখন তাকে বায়ুর উচ্চচাপ (High Pressure) বলা হয় ।

উদাঃ

পৃথিবীর উত্তরে সুমেরু ও দক্ষিণে কুমেরু অঞ্চলের বায়ুতে স্থায়ী উচ্চচাপ বিরাজ করে ।

বৈশিষ্ট্যঃ

বায়ুর উচ্চচাপ – এর বৈশিষ্ট্যগুলি হলো নিম্নরূপ

  • উচ্চচাপ বায়ুর ঘনত্ব বৃদ্ধি করে ।
  • উচ্চচাপযুক্ত অঞ্চলের বায়ু ওজনে যথেষ্ট ভারী হয় ।
  • সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের তাপমাত্রা হ্রাস পেয়ে বায়ুতে উচ্চচাপ সৃষ্টি হয় ।
  • উচ্চচাপযুক্ত অঞ্চলে আবহাওয়া পরিস্কার ও দুর্যোগমুক্ত থাকে ।

নিম্নচাপঃ

ভূ-পৃষ্ঠের কোনো নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট আয়তনের বায়ুর চাপ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অপেক্ষা কমে গিয়ে যদি সেটি ৯৮৬ মিলিবার বা তার কম হয়, তখন তাকে বায়ুর নিম্নচাপ (Low Pressure) বলে ।

উদাঃ

পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চলের বায়ুতে স্থায়ী নিম্নচাপ বিরাজ করে ।

বৈশিষ্ট্যঃ

বায়ুর নিম্নচাপ – এর বৈশিষ্ট্যগুলি হলো নিম্নরূপ

  • নিম্নচাপ বায়ুর ঘনত্ব হ্রাস করে ।
  • নিম্নচাপযুক্ত অঞ্চলের বায়ু ওজনে যথেষ্ট হালকা হয় ।
  • সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে বায়ুতে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় ।
  • নিম্নচাপযুক্ত অঞ্চলে আবহাওয়া ক্রমশ মেঘলা ও দুর্যোগময় হতে থাকে ।

গুরুত্বঃ

বায়ুচাপ – এর গুরুত্বগুলি হলো নিম্নরূপ

  1. বায়ুচাপের তারতম্যের কারণেই বায়ুপ্রবাহ হয় ।
  2. বায়ুচাপের পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ারও পরিবর্তন ঘটে ।
  3. গভীর নিম্নচাপ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি করে ।
  4. আবহাওয়া মানচিত্রে বায়ুচাপের বন্টন ও প্রকৃতি দেখে আবহওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয় ।

বায়ুচাপের তারতম্যের কারণ বা নিয়ন্ত্রকসমূহঃ

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বায়ুচাপ বিভিন্ন রকমের হয়, সেই কারণগুলি হলো নিম্নরূপ

  1. বায়ুর উষ্ণতার পার্থক্যঃ উষ্ণতায় বায়ু প্রসারিত হয় এবং এর ঘনাঙ্ক কমে যায় । ফলে এটি হালকা হয়ে পড়ে । হালকা বায়ুর চাপও কম হয় । আবার, উষ্ণ বায়ুর বাষ্প ধারণের ক্ষমতা বেশী বলে এর নিকটবর্তী অঞ্চলে জলাশয় থাকলে এটি আর্দ্র হয় ও কম চাপ দেয় । কিন্তু, শীতল বায়ুর বাষ্প ধরে রাখবার ক্ষমতা কম বলে বেশী চাপ দেয় । সেইজন্য উষ্ণতা বেশী হলে বায়ুচাপ কম হয় ।
  2. বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণের পার্থক্যঃ জলীয় বাষ্প বিশুদ্ধ বায়ুর থেকে হালকা । সেইজন্য জলীয় বাষ্পপূর্ণ আর্দ্র বায়ু শুস্ক বায়ুর থেকে হালকা এবং তার চাপও শুস্ক বায়ুর থেকে কম । এই কারণে শীতকালে বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম থাকার কারণে বায়ুচাপ বেশী হয় এবং বর্ষাকালে বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশী থাকার কারণে বায়ুচাপ কম হয় ।
  3. ভূ-পৃষ্ঠের উচ্চতাঃ সমুদ্রতল থেকে যতই উপরে ওঠা হয় ততই বায়ুস্তরের গভীরতা কমতে থাকে । সেইজন্য বায়ুর চাপও কমে যায় । পরীক্ষা করে দেখা গেছে প্রতি ২৭৪ মিটার উচ্চতায় ৩৪ মিলিবার করে বায়ুর চাপ কমে যায় । আর ঠিক এই কারণেই পার্বত্য অঞ্চলে সমভূমি অপেক্ষা বায়ুচাপ কম হয় ।
  4. পৃথিবীর আবর্তন গতিঃ পৃথিবীর আবর্তন গতির ফলে কোরিওলিস বল সৃষ্টি হয় । এই কোরিওলিস বলজনিত কেন্দ্র বহির্মুখী শক্তির প্রভাবে বায়ুমন্ডলের বায়ু বাইরের দিকে চলে যেতে চায় এবং সেইজন্য বায়ুচাপেরও তারতম্য হয়ে থাকে ।
    প্রসঙ্গত বলা যায়, প্রচন্ড ঠান্ডার জন্য দুই মেরু অঞ্চলে বায়ু উচ্চচাপযুক্ত হয় । আবর্তন গতির ফলে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ওই উচ্চচাপযুক্ত মেরুবায়ু ছিটকে যায় । ফলে সুমেরু বৃত্ত ও কুমেরু বৃত্তের কাছে বায়ুচাপ হ্রাস পেয়ে নিম্নচাপ বলয়ের সৃষ্টি করে । এছাড়া আবর্তন গতির ফলে নিরক্ষীয় অঞ্চলের উষ্ণ বায়ু উপরে উঠে উত্তর-দক্ষিণ উভয় দিকেই ছিটকে যায় । এর ফলে নিরক্ষীয় অঞ্চলে বায়ুর চাপ কমে যায় । কিন্তু ওই বায়ু ক্রান্তীয় অঞ্চলে পুনরায় নীচে নেমে আসে বলে বায়ুচাপ বেশী হয় ।
  5. ভূ-পৃষ্ঠে জলভাগ ও স্থলভাগের বন্টনঃ ভূপৃষ্ঠে জলভাগ ও স্থলভাগের বন্টন বায়ুর চাপের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে । সমুদ্রের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু আদ্র ও হালকা হওয়ার কারণে তার চাপ যেমন কম থাকে, তেমনই স্থলভাগের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু শুষ্ক ও ভারী হওয়ার কারণে তার চাপও বেশী হয় ।
  6. বায়ুমন্ডলের গভীরতাঃ বায়ুমন্ডলের ঘনত্ব বা গভীরতা বায়ুচাপের তারতম্যের অন্যতম নিয়ন্ত্রক । যে অঞ্চলে বায়ুমন্ডলের গভীরতা বেশী হয়, সেখানে বায়ুর অণুর পরিমাণ বেশি থাকার জন্য সেখানে বায়ুচাপ কম হয় । আবার, যে অঞ্চলে বায়ুমন্ডলের গভীরতা কম হয় সেখানে বায়ুতে অণুর পরিমাণ কম থাকে বলে বায়ুর চাপও কম হয় ।
  7. অভিকর্ষজ টানঃ বায়ুর চাপের তারতম্যের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক হল অভিকর্ষজ টান । পৃথিবীর যে স্থান কেন্দ্রের যত নিকটবর্তী সেইস্থানে অভিকর্ষজ টানের প্রভাব ততই বেশী । পৃথিবীর আকৃতি অভিগত গোলকের মত হওয়ায় নিরক্ষীয় অঞ্চলে বায়ুচাপ কম হয় এবং মেরু অঞ্চলে বায়ুচাপ বেশী হয় ।
  8. বায়ুমন্ডলের গঠনকারী উপাদানঃ বায়ুমন্ডল গঠনকারী উপাদানগুলিও বায়ুচাপের তারতম্যের অন্যতম নিয়ন্ত্রক । স্থানবিশেষে বায়ুতে উপাদানের তারতম্য থাকলে তার পরিপ্রেক্ষিতে বায়ুর চাপেরও তারতম্য দেখা যায় । যেসব স্থানের বায়ুতে বালিকণা, ধূলিকণা, কার্বন কণা প্রভৃতি ভারী উপাদান থাকে, সেখানে বায়ুচাপ বেশী হয় । আবার, যেসব স্থানের বায়ুতে হাইড্রোজেন, ওজোন, হিলিয়াম প্রভৃতি হালকা উপাদান থাকে, সেখানে বায়ুচাপ কম হয় ।

উপরোক্ত অংশ থেকে কোনো বিস্ময় থাকলে অবশ্যই নিচে মন্তব্য করুন এবং প্রশ্নের বিষয়টি আপনার কোনো সাহায্যপ্রাপ্ত হলে আপনার বন্ধুদের কাছেও প্রশ্নের বিষয়টি শেয়ার করুন। বিষয়টি পরে অধ্যায়ন করার জন্য বা নিজের কাছে সংরক্ষিত করে রাখার জন্য সরাসরি পিডিএফ (PDF) ফাইল ডাউনলোড করুন ধন্যবাদ।