ওজোন বিনাশন, ওজোন ছিদ্র বা ওজোন গহবর কি ? এর কারণ,প্রভাব ও প্রতিরোধের উপায় লেখ ?

2
ওজোন বিনাশন, ওজোন ছিদ্র বা ওজোন গহবর কি এবং এর কারণ,প্রভাব ও প্রতিরোধের উপায় লেখ ?

আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাই, আজ আমার ভূগোলের একটি গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করবো যে প্রশ্নটি পরীক্ষার জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই প্রশ্নটি তারা অধ্যায়ন করলে পরীক্ষায় খুব সহজেই ভালো নম্বর অর্যন করতে পারবে। ওজোন বিনাশন,ওজোন ছিদ্র বা ওজোন গহবর কি এবং এর কারণ, প্রভাব ও প্রতিরোধের উপায় এই প্রশ্নটি নিয়ে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। 

Advertisement

ওজোন বিনাশন, ওজোন ছিদ্র বা ওজোন গহবর কি এবং এর কারণ,প্রভাব ও প্রতিরোধের উপায় লেখ ?

পরিচিতিঃ

ওজোন স্তর একটি প্রাকৃতিক সৌরপর্দা, যা বায়ুমন্ডলে উপস্থিত থেকে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মিকে ভূপৃষ্ঠে প্রবেশ করতে বাঁধা দেয় । কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে ক্রমবর্দ্ধমান ক্লোরিন পরমানুর প্রভাবে এই ওজোন স্তর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে ক্রমশ পাতলা হয়ে পড়ছে, যাকে ওজোন বিনাশন (Ozone Dipletion) বলা হচ্ছে । আন্টার্কটিকায় শীতকালে সূর্যের অনুপস্থিতির জন্য নিম্ন স্ট্রাটোস্ফিয়ারে উষ্ণতা কমে গিয়ে বায়ুর তাপ দ্রুত হ্রাস পায় । বায়ুর এই দ্রুত তাপহ্রাস ও পৃথিবীর দ্রুত ঘূর্ণনের জন্য আন্টার্কটিকায় ভর্টেক্স (Vortex) সৃষ্টি হয় । এই ভর্টেক্স মধ্যস্থ বায়ুর গতিবেগ ঘন্টায় ৩০০ কিমির বেশি হয় । ফলে এই ভর্টেক্স মধ্যস্থ হাইড্রোজেন ক্লোরাইড ও ক্লোরিন নাইট্রেটের সংঘাতে আনবিক ক্লোরিন গ্যাস উৎপন্ন হয়, যা পরবর্তীকালে বসন্তের শুরুতে অতিবেগুনী রশ্মির দ্বারা বিয়োজিত হয়ে ক্লোরিন পরমানু সৃষ্টি করে । এই ক্লোরিন পরমানু ঐ অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ ওজোন অনুকে ক্রমশ ভেঙ্গে দিতে থাকে; যার ফলস্বরূপ আন্টার্কটিকার ওজোন স্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ক্রমশ পাতলা হয়ে পড়ছে এবং স্থানে স্থানে তা প্রায় পুরোপুরি বিনষ্ট হয়ে পড়েছে, যেখান দিয়ে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি সরাসরি ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ছে । একেই ওজোন ছিদ্র বা ওজোন গহবর (Ozone Hole) বলা হচ্ছে ।

ওজোন স্তর বিনাশনের কারণঃ

ওজোন বিনাশনের কারণগুলি মূলত দুই প্রকার । যথা – প্রাকৃতিক কারণ মনুষ্যসৃষ্ট কারণ । নীচে এগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো

প্রাকৃতিক কারণঃ

ওজোন স্তর বিনাশনের জন্য দায়ী প্রাকৃতিক কারণগুলি হলো – ১. বজ্রপাত ২. অগ্নুদ্গম ৩. আলোক-রাসায়নিক বিক্রিয়া ৪. অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাব প্রভৃতি । এই সমস্ত কারণগুলি মূলত নিম্নলিখিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ওজোন গ্যাসের অনুকে ভেঙ্গে দিয়ে ওজোন স্তর বিনাশন ঘটায় । তবে এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে প্রাকৃতিক কারণে ওজোন স্তর যেমন ধংস হয়, তেমনই প্রাকৃতিক কারণে এটি গড়েও ওঠে । তাই ওজোন স্তর বিনাশনের পিছনে প্রাকৃতিক কারণগুলি তেমন মারাত্মক প্রভাব ফেলে না ।

মনুষ্যসৃষ্ট কারণঃ

ওজোন স্তর বিনাশনের পিছনে মূলত মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলিই বেশী দায়ী । এগুলি হলো নিম্নরূপ

  • ক্লোরোফ্লোরোকার্বন(CFC): ক্লোরোফ্লোরোকার্বন(CFC) বা ফ্রেয়ন একটি বিশেষ যৌগ, যা ওজোন স্তর বিনাশনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী । এটি আবার তিন ধরনের; যথা – CFC-11(CFCl3),CFC-12(CF2Cl2),CFC-113(CF2Cl.CF2Cl); ১৯৯৫ সালের পর থেকে বিশেষজ্ঞরা এটি থেকে নির্গত ক্লোরিনকে ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী করেন । একটি ক্লোরিন পরমানু প্রায় এক লক্ষ ওজোন অনুকে ভেঙে দেওয়ার পরও অপরিবর্তিত থাকে । O3 + Cl > O2 + O + Cl

উৎসঃ রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, ফোম শিল্প, রং শিল্প, প্লাস্টিক শিল্প, সুগন্ধি শিল্প, কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রের সার্কিট পরিষ্কার প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে CFC নির্গত হয় । এছাড়াও কলকারখানা-যানবাহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, ট্যাঁনারি কারখানার বর্জ্য পদার্থ যা পরবর্তীতে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে ক্লোরিন গ্যাস তৈরিতে ভূমিকা রাখে ।

  • নাইট্রাস অক্সাইড(N2O): নাইট্রাস অক্সাইড হলো অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস যা ওজোন বিনাশনে ভূমিকা নেয় ।

উৎসঃ কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, যানবাহন, নাইলন শিল্প প্রভৃতি ।

  • নাইট্রোজেন অক্সাইড(NO): ওজোন স্তর বিনাশনের পিছনে দায়ী অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো নাইট্রোজেন অক্সাইড ।

উৎসঃ জেট বিমান

  • ব্রোমিন পরমাণুঃ হ্যালোন যৌগ অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাবে ভেঙে গিয়ে ব্রোমিন পরমাণুর সৃষ্টি হয় । এই ব্রোমিন পরমাণু ওজোন বিনাশক হিসাবে কার্যকরী ভূমিকা নেয় ।

উৎসঃ অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র

  • সালফারের কণাঃ ওজোন ধংসের পিছনে দায়ী উপাদানগুলির মধ্যে সালফারের কণাও ভুমিকা রাখে ।

উৎসঃ কলকারখানা, যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া প্রভৃতি ।

উপরে উল্লিখিত কারণগুলি ছাড়াও মিথেন, মিথাইল ব্রোমাইড, মিথাইল ক্লোরাইড প্রভৃতি ওজোন ধ্বংসকারী গ্যাস সৃষ্টিও অন্যান্য মনুষ্যসৃষ্ট কারণ ।

ওজোন স্তর বিনাশনের প্রভাবঃ

জীবজগতের ওপর ওজন স্তর ক্ষয়ের প্রভাব সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা নানা তথ্য দিয়েছেন । তাঁরা ধারণা করছেন ওজন স্তর ক্ষয়ের কারণে অতি বেগুনী রশ্মি পৃথিবী পৃষ্ঠে চলে এলে নিম্নলিখিত ক্ষতিগুলি হতে পারে

মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর উপর প্রভাবঃ

মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর উপর ওজন স্তর ক্ষয়ের প্রভাব নিম্নরূপ

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাবে ।
  • চোখে ছানি পড়বে ।
  • ত্বকের ক্যান্সার এবং অন্যান্য রোগব্যাধির সূচনা হবে । ( ধারনা করা হচ্ছে যে, ৫% ওজন স্তরের ক্ষয়ের জন্য সারা বিশ্বে ৫ লাখ লোক স্কীন ক্যান্সারে ভুগবে । একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১% অতি বেগুনী রশ্মি বৃদ্ধির ফলে সাদা চামড়ার লোকদের মধ্যে নন মেলোনোমা ত্বকের ক্যান্সার বৃদ্ধি পাবে ৪ গুণ । )
  • প্রাণী জগতের অনেক প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে ।
  • অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাব কোষের উপর খুবই ক্ষতিকারক । এটা কোষের সৃষ্টি এবং বৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে কোষগুলোকে ভেঙ্গে ফেলতে পারে ।
  • প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাবে ।
  • নখ ও চুল ক্ষতিগ্রস্ত হবে ।
  • গড় আয়ু হ্রাস পাবে ।
  • উভচর প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত কমবে ।

উদ্ভিদের উপর প্রভাবঃ

উদ্ভিদের উপর ওজন স্তর ক্ষয়ের প্রভাব নিম্নরূপ

  • অতি বেগুনী রশ্মি খাদ্যশস্যের ক্ষতি করবে ।
  • বৃক্ষাদি এবং অরণ্যসমূহের পরিমান ক্রমশ হ্রাস পাবে ।
  • উদ্ভিদের পাতাগুলো আকারে ছোট ও হলুদ হয়ে যাবে অর্থাৎ, উদ্ভিদ ক্লোরোসিস রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বে ।
  • বীজের উৎকর্ষতা নষ্ট হবে ।
  • ফসলের আগাছা, রোগ ও পোকা মাকড়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পাবে ।
  • ক্ষুদ্র মাইক্রোঅর্গানিজম, সমুদ্র শৈবাল এবং প্লাংকটন অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে ।
  • অতি বেগুনী রশ্মির প্রভাব উদ্ভিদ কোষের উপর খুবই ক্ষতিকারক । এটা উদ্ভিদ কোষের সৃষ্টি এবং বৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে কোষগুলোকে ভেঙ্গে ফেলতে পারে ।
  • উদ্ভিদের অকালমৃত্যুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে ।
  • উদ্ভিদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে ।
  • উদ্ভিদের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাবে ।

পরিবেশের উপর প্রভাবঃ

পরিবেশের উপর ওজন স্তর ক্ষয়ের প্রভাব নিম্নরূপ

  • প্রাকৃতিক খাদ্যচক্রের ক্ষতিসাধন করবে ।
  • উষ্ণতার বৈপরীত্য ঘটবে ও পৃথিবীর উষ্ণতার ভারসাম্য বিপন্ন হবে ।
  • জীব বৈচিত্র বিপন্ন হবে ।
  • বিশ্ব উষ্ণায়ন তরান্বিত হবে ।
  • ধোঁয়াশা ও অ্যাসিড বৃষ্টির পরিমান বৃদ্ধি পাবে ।

ওজোন স্তর বিনাশন প্রতিরোধের উপায়ঃ

ওজোন স্তর বিনাশন প্রতিরোধের উপায়গুলি নিম্নরূপ

  1. CFC-এর ব্যবহার হ্রাসঃ ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (CFC11,CFC12) বা ফ্রেয়ন একটি বিশেষ যৌগ, যা ওজোন স্তর বিনাশনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী । এই CFC প্রধানত রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, ফোম শিল্প, রং শিল্প, প্লাস্টিক শিল্প, সুগন্ধি শিল্প, কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রের সার্কিট পরিষ্কার প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে নির্গত হয় । CFC নির্গমনের এই সকল উৎসগুলিকে ক্ষেত্রবিশেষে বন্ধ অথবা সর্বোচ্চমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ।
  2. নাইট্রাস অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফারের কণা নিয়ন্ত্রণঃ কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, যানবাহন, নাইলন শিল্প প্রভৃতি কলকারখানা-যানবাহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, ট্যাঁনারি কারখানার বর্জ্য পদার্থ, জেট বিমান, রকেট উৎক্ষেপণ, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র প্রভৃতি থেকে নাইট্রাস অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফারের কণা নির্গত হয় যেগুলি ভীষণভাবে এক একটি গুরুত্বপূর্ণ ওজোন বিনাশক । এদের উৎসগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশে এদের পরিমান কমাতে হবে ।
  3. মন্ট্রিল চুক্তির বাস্তবায়নঃ ওজোন স্তর সংরক্ষনের উদ্দ্যেশ্যে ১৯৮৭ সালে কানাডার মন্ট্রিলে সাক্ষরিত মট্রিল চুক্তি যাতে বাস্তবে সবাই মেনে চলে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে
  4. এজেন্ডা ২১ এর রূপায়ণঃ ১৯৯২ সালের জুন মাসে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত বসুন্ধরা সম্মেলনে গৃহীত এজেন্ডা ২১ এর অন্তর্ভূক্ত সকল পালনীয় বিষয়গুলিকে সবাইকেই মেনে চলতে হবে ।
  5. বিকল্প ও পরিবেশবান্ধব দ্রব্য ব্যবহারঃ ওজোন বিনাশক উপাদানগুলির বিকল্প ও পরিবেশবান্ধব দ্রব্যগুলি ব্যবহারের উপর জোর দিতে হবে ।
  6. নাগরিক দায়িত্বঃ পরিবেশ রক্ষা নাগরিকদের মৌলিক দায়িত্ব । তাই CFC সহ অন্যান্য ওজোন বিনাশক উপাদানগুলি যাতে পরিবেশে কম পরিমানে উৎপাদিত হয়, সে বিষয়ে সকলকেই দায়িত্বশীল হতে হবে ।

উপরোক্ত অংশ থেকে কোনো বিস্ময় থাকলে অবশ্যই নিচে মন্তব্য করুন এবং প্রশ্নের বিষয়টি আপনার ভালো লাগলে আপনার বন্ধুদের কাছেও শেয়ার করতে ভুলবেন না। প্রশ্নটি পরে অধ্যায়ন করার জন্য বা নিজের কাছে সংরক্ষিত করার জন্য সরাসরি পিডিএফ (PDF) ফাইল ডাউনলোড করুন ধন্যবাদ। 

2 COMMENTS

Comments are closed.