আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাই, আজ আমরা শিখবো ভূগোলের একটি গুরত্বপূর্ন বিষয় যে বিষয়টি পরীক্ষার জন্য খুবই উপযোগী। ছাত্রছাত্রীরা বিষয়টি অধ্যায়ন করলে তারা সহজেই পরীক্ষায় খুব ভালো নম্বর অর্যন করতে পারবে। দামােদর উপত্যকা পরিকল্পনা সম্পর্কে বিষয়টি নিয়ে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
দামােদর উপত্যকা পরিকল্পনা সম্পর্কে লেখ?
পরিচিতিঃ দামােদর নদ বিহারের ছােটনাগপুর মালভূমির পালামৌ জেলার ১০৫০ মিটার উঁচু খামারপত নামক পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে ৫৩৮ কিলােমিটার পথ অতিক্রম করে অবশেষে কলকাতা থেকে ৫৮ কিলােমিটার দক্ষিণে ফলতার বিপরীত দিকে হুগলী নদীতে মিশেছে । বরাকর , জামুনিয়া , কোনার , বােকারাে প্রভৃতি এর উপনদী । ছােটনাগপুর অঞ্চল থেকে এই নদী প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে ক্ষয়প্রাপ্ত মৃত্তিকা , প্রস্তরখণ্ড , বালুকণা প্রভৃতি বহন করে এনে নদীর নিম্ন প্রবাহে নদীগর্ত ভরাট করত । ফলে প্রতি বৎসর বর্ষাকালে যে পরিমাণ জল নদীতে আসত , তা নদীখাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে না পারায় চীনের হােয়াং হাে নদীর মত প্রতি বৎসর অতিরিক্ত জলে নদীর উভয়পার্শ্ব প্লাবিত হয়ে এই নদীতেও বন্যা দেখা দিত এবং তার ফলে বহু সম্পত্তি বিনষ্ট হত ও বহু লােকের জীবনহানি ঘটত । এই কারণে দামােদর নদ পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের নিকট ‘ দুঃখের নদ ’ বলেই পরিচিত ছিল । ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দের প্রবল বন্যার পর দামোদরের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয় । ঐ কমিটি আমেরিকা যুক্তরাষ্টের টেনিসি ভ্যালি অথরিটি – র অনুকরণে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে , যা দামােদর উপত্যকা পরিকল্পনা নামে পরিচিত । ঐ পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৪৮ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে স্বাধীন ভারতে দামােদর ভ্যালি কর্পোরেশন বা D. V. C. গঠিত হয় এবং তার তত্বাবধানে এই পরিকল্পনার কাজ চলতে থাকে ।
পরিকল্পনার উদ্দেশ্যঃ এই পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল দামােদর উপত্যকার সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন । এই পরিকল্পনায় কেবল বন্যা নিয়ন্ত্রণ , জলসেচ , বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহণের ব্যবস্থাই করা হয়নি , তার সাথে নৌপরিবহণ , মৃত্তিকা সংরক্ষণ , মৎস্য চাষ , জলক্রীড়া ও আমােদ প্রমােদ প্রভৃতি বিভিন্ন কর্মসূচীও অন্তভুক্ত করা হয় । এগুলি নিচে আলোচনা করা হল
- বন্যা নিয়ন্ত্রণঃ এই পরিকল্পনার একটি প্রধান উদ্দেশ্য হল বন্যা নিয়ন্ত্রণ । বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন নদীতে ৮ টি বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল । এই বাঁধগুলি হল তিলাইয়া , কোনার , মাইথন , পাঞ্চেত , বলপাহাড়ী , বার্মো ও আয়ার । এর মধ্যে তিলাইয়া , কোনার , মাইথন ও পাঞ্চেত — এই চারটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রূপায়িত হয় এবং অপর চারটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা স্থগিত থাকে । পরবর্তীকালে অবশ্য বিহারের তেনুঘাটে দামােদরের উপর আরও একটি বাঁধ নির্মিত হয়েছে । বেলপাহাড়ীতে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে । নিম্নে পাঁচটি বাঁধ সম্বন্ধে আলােচনা করা হল –
১. তিলাইয়া বাঁধ – ১৯৫৩ খ্রীষ্টাব্দে এই বাঁধটি বরাকর নদের উপর নির্মিত হয়েছে । এর দৈর্ঘ্য ৩৬৬ মিটার এবং উচ্চতা ৩৪ মিটার । বাঁধটি বিহারে অবস্থিত । এই বাঁধের জলধারণ ক্ষমতা ৩৯,৬৮০ হেক্টর মিটার ।
২. কোনার বাঁধ – কোনার নদীর উপর নির্মিত এই বাঁধটির দৈর্ঘ্য ৩,৯২১ মিটার এবং উচ্চতা ৬০ মিটার । ১৯৫৪ খ্রীষ্টাব্দে এর নির্মাণকার্য শেষ হয় । এই বাঁধের জলাধার থেকে নিকটবর্তী কোনাে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জল সরবরাহ করা হয় । এই বাঁধটিও বিহারে অবস্থিত ।
৩. মাইথন বাঁধ – পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার সীমানায় বরাকর নদের উপর এই বাঁধটি নির্মিত হয় । এর দৈর্ঘ্য ৬১৯ মিটার ও উচ্চতা ৪৮ মিটার । এই বাঁধের জলধারণ ক্ষমতা ১৩,৬১০ লক্ষ ঘন মিটার ।
৪. পাঞ্চেত বাঁধ – পাঞ্চেত পাহাড়ের নিকট দামোদর নদের উপর বিহার – পশ্চিমবঙ্গ সীমানায় এই বাঁধটি নির্মাণ করা হয় । বাঁধটির দৈর্ঘ্য ২,১৩০ মিটার ও উচ্চতা ৪০ মিটার । এই বাঁধের জলধারণ ক্ষমতা ১৪,৯৭০ লক্ষ ঘন মিটার ।
৫. তেনুঘাট বাঁধ – বােকারাে ইস্পাত কারখানায় জল সরবরাহের জন্য বোকারো – র নিকট তেনুঘাটে দামােদরের উপর এই বাঁধটি নির্মিত হয়েছে ।
- জলসেচঃ জলসেচ ব্যবস্থার জন্য ১৯৫৫ খ্রীষ্টাব্দে দুর্গাপুরে একটি সেচবাঁধ ( Barrage ) নির্মাণ করা হয় । দুর্গাপুর ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ৬৯২ মিটার এবং উচ্চতা ১২ মিটার । দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে দুই তীরে দুইটি প্রধান খাল কাটা হয়েছে । বামদিকের খালটি ১৩৬ কিলােমিটার দীর্ঘ এবং এটি ত্রিবেণীর নিকট হুগলী নদীতে এসে মিলিত হয়েছে । ডানদিকের খালটি ৮৮ কিলােমিটার দীর্ঘ । এই দুই প্রধান খাল থেকে বিভিন্ন মাঝারি ও ক্ষুদ্র খাল দামােদরের নিম্ন অববাহিকায় বিভিন্ন কৃষিক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করেছে । এই সেচখালগুলির মােট দৈর্ঘ্য ২,২৬২ কিলােমিটার । বিভিন্ন বাঁধে আবদ্ধ জল এই সেচবাধ বা ব্যারেজে সংগ্রহ করে তা বিভিন্ন খাল মাধ্যমে বর্ধমান , বাঁকুড়া , হুগলী ও হাওড়া জেলায় সেচকার্যে ব্যবহার করা হচ্ছে । এর ফলে খারিফ মরশুমে ৪৭৫ লক্ষ হেক্টর এবং রবি মরশুমে ২২ হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে জলসেচ করা হচ্ছে ।
- জলবিদ্যুৎ উৎপাদন – দামােদর উপত্যকা অঞ্চল , বিশেষতঃ উচ্চ উপত্যকা বিভিন্ন মূল্যবান খনিজসম্পদে ( যথা – কয়লা , লৌহ , তাম্র , অভ্র , চীনামাটি , কায়ানাইট , অ্যাসবেস্টস্ প্রভৃতি ) সমৃদ্ধ । সুলভ জলবিদ্যুৎ শক্তি প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন করার লক্ষ্যে মাইথন , পাঞ্চেত ও তিলাইয়াতে তিনটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয় । কিন্তু এই তিনটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা খুবই সামান্য । সেই কারণে প্রচুর কয়লা সম্পদে সমৃদ্ধ দামােদর অঞ্চলের কয়লার সাহায্যে চন্দ্রপুরা ( ৫৬০ মেগাওয়াট ) , দুর্গাপুর ( ২৯০ মেগাওয়াট ) ও বােকারােতে ( ২৪৭ মেগাওয়াট ) তিনটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে । ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক উল্লেখযােগ্য অংশ বিদ্যুৎ দামােদর উপত্যকা অঞ্চলে উৎপন্ন হয় । এই বিদ্যুৎ বিহার , ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ব্যবহৃত হয় । কলকাতা ও তৎসংলগ্ন শিল্পাঞ্চলেও এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় । নিচে এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল –
১. মাইথন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র – এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বৈশিষ্ট্য হল এটি পাহাড়ের অভ্যন্তরে সুড়ঙ্গ কেটে নির্মিত । দামােদর উপত্যকার তিনটি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মধ্যে এটি সর্বাপেক্ষা অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন । এই কেন্দ্রে প্রতিটি ২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাযুক্ত তিনটি ইউনিটে মােট ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় । এই কেন্দ্রটির নির্মাণকার্য ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দে আরম্ভ হয় এবং ১৯৫৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ।
২. পাঞ্চেত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র – দামােদর নদের উপর গড়ে ওঠা এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিটে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়ে থাকে । ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দে শুরু করে ১৯৫৯ খ্রীষ্টাব্দে এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকার্য শেষ হয় ।
৩. তিলাইয়া জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র – তিলাইয়া বাঁধের ঠিক নীচে এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে । এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ৪ মেগাওয়াট ।
- পরিবহণঃ দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে যে দুইটি খাল কাটা হয়েছে সেই খাল দুইটি এবং অন্যান্য শাখাখালের মধ্য দিয়ে জলপথে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছে । দুর্গাপুর ব্যারেজের বামতীরের ১৩৬ কিঃ মিঃ দীর্ঘ খালটি ত্রিবেণীর নিকট হুগলীতে মিলিত হয়েছে । ঐ খাল মাধ্যমে দুর্গাপুর , রাণীগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চল এবং কলকাতা শিল্পাঞ্চলের মধ্যে কয়লা ও শিল্পজাত দ্রব্য আদান – প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে ।
- মৎস্যচাষঃ তিলাইয়া , মাইথন , পাঞ্চেত প্রভৃতি বাঁধের পশ্চাতে সৃষ্ট জলাশয়গুলিতে স্বাদু জলের মৎসের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে মৎস্যচাষের ব্যবস্থা করা হয়েছে ।
- পর্যটনের বিকাশঃ স্থানীয় ভূ – প্রাকৃতিক সৌন্দর্য , কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট জলাশয়গুলিতে বোটিং , মৎস শিকার , পিকনিকসহ বিভিন্ন আমোদপ্রমোদের স্থান হিসাবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলিতে প্রায় সারা বছর ধরেই পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই থাকে ।
উপকৃত অঞ্চলঃ দামােদর উপত্যকা পরিকল্পনা রূপায়িত হওয়ার ফলে বিহারের হাজারিবাগ , পালামৌ , রচী , ধানবাদ ও সাঁওতাল পরগণা এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া , বর্ধমান , পুরুলিয়া , হুগলী ও হাওড়া প্রভৃতি জেলা নানা দিক থেকে উপকৃত হয়েছে । পশ্চিমবঙ্গে দামােদরের নিম্ন উপত্যকায় বন্যার প্রকোপ অনেক কমেছে বটে , তবে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়নি । এখনও নিম্ন উপত্যকা অঞ্চলে মাঝে মাঝেই বন্যার প্রকোপ দেখা দেয় । এই প্রকল্পে নিম্ন উপত্যকায় সামগ্রিকভাবে সেচ ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে , যার ফলে শস্য উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে । DVC – র তাপ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ আসানসােল – দুর্গাপুর , ধানবাদ – বােকারাে , এমনকি কলকাতা মহানগরী ও তৎসংলগ্ন শিল্পাঞ্চলসমূহে ব্যবহৃত হয় । DVC থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ পূর্ব এবং দক্ষিণ – পূর্ব রেলপথও ব্যবহার করে ।
উপরোক্ত বিষয়টি নিয়ে কোনো বিস্ময় থাকলে নীচে মন্তব্য করুন এবং প্রশ্নের বিষয়টি আপনার কাছে সাহায্য দায়ক মনে হলে আপনার বন্ধুদের কাছেও শেয়ার করে তাদের কেও সাহায্য করুন। বিষয়টি পরে অধ্যায়ন করার জন্য বা নিজের কাছে সংরক্ষিত করে রাখার জন্য সরাসরি পিডিএফ (PDF) ফাইল ডাউনলোড করুন ধন্যবাদ।